রিপোর্টার- স্বাগতম বসাক, সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি।
শত শত বছর ধরে কামারখন্দ উপজেলার চাঁদপুর ও ঝাঐল গ্রামের মানুষ শীতল পাটি বুনে শীতল পাটি শিল্পের প্রাচীন ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছেন। এজন্য সারা বাংলাদেশে এ গ্রাম দুটি শীতল পাটির জন্য বিখ্যাত। বর্তমানে এ দুটি গ্রামের ২০০ পরিবারের প্রায় ৮০০ নারী-পুরুষ এ পেশার সাথে জড়িত। হস্তশিল্প হিসাবে শীতল পাটির যথেষ্ট কদর রয়েছে। পরশের পাশাপাশি বর্ণিল নকশা সবাইকে মুগ্ধ করে। যদিও আধুনিতার ছোঁয়ায় এর স্থান প্লাস্টিক পাটি, চট-কার্পেট, মোটা পলিথিন দখল করে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের অংশ এই শীতল পাটি শিল্প। শীতল পাটি এক ধরনের মেঝেতে বা বিছনায় পাতা আসন বা গালিচা। গরমে শান্তির পরশ পেতে এ পাটির জুড়ি মেলা ভার। তীব্র গরমেও এ পাটি শীতল অনুভূতি এনে দেয়। আগের দিনে যখন বিদ্যুৎ ছিল না, তখন কাঁথা বা তোশকের ওপর মিহি বেতের নকশি করা এই পাটি ব্যবহার হতো। তাতে গা এলিয়ে দিলে শরীর ও মনে শীতল পরশ অনুভূত হয় বলে এ পাটিকে শীতল পাটি বলা হয়।
যে ব্যক্তি পাটি তৈরী করে তাকে বলা হয় পাটিকর বা পাটিয়াল। আর যে গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ থেকে শীতল পাটি তৈরী করা হয় তার স্থানীয় নাম ‘মুর্তা’। স্থানভেদে একে মুসতাক, পাটিবেত, হারিযাতা গাছ, পাটিগাছ বা পাইত্রা ইত্যাদি নামেও অভিহিত হয়ে থাকে। মুর্তা গাছ দেখতে সরু বাঁশের মতো; জন্মে ঝোঁপ আকারে। গোড়া থেকে কেটে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় মুর্তার কাÐ। দা দিয়ে চেঁছে পাতা ও ডাল-পালা ফেলে দেয়া হয়, দূর করা হয় ময়লা। এরপর মাটিতে মাছকাটার বটি ফেলে মুর্তার কাÐটিকে চিড়ে লম্বালম্বি কমপক্ষে চারটি ফালি বের করা হয়। কাÐের ভেতর ভাগে সাদা নরম বুকা চেঁছে ফেলে দেয়া হয়। পাটিকরের লক্ষ্য থাকে মুর্তার ছাল থেকে যতটা সম্ভব সরু ও পাতলা বেতী তৈরী করে নেয়া। বেতী যত সরু ও পাতলা হবে পাটি তত নরম ও মসৃণ হবে। বেতী তৈরী হওয়ার পর এক-একটি গুচ্ছ বিড়ার আকারে বাঁধা হয়। তারপর সেই বিড়া ঢেকচিতে পানির সঙ্গে ভাতের মাড় এবং আমড়া, জারুল ও গেওয়া ইত্যাদি গাছের পাতা মিশিয়ে সিদ্ধ করা হয়। এর ফলে বেতী মোলায়েম, মসৃণ ও চকচকে হয়। রঙ্গীন নকশাদার পাটি তৈরীর জন্য সিদ্ধ করার সময় ভাতের মাড় ইত্যাদির সঙ্গে রঙের গুঁড়া মেশানো হয়। পাটিকর মাটিতে বসে কাপড় বোনার মতই দৈর্ঘ্য-বরাবর এবং প্রস্থ-বরাবর বেতীগুলোকে ঘন আঁট-সাঁট করে বসানো হয় যাতে কোন ফাঁক-ফোকড় না থাকে। নকশী পাটির ক্ষেত্রে পাটিকর তার মনের মাদুরী থেকে রঙ্গীন বেতী দিয়ে নকশা তৈরী করে। শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় ফুটে উঠে বর্ণিল ফুল, ফল, পশুপাখি, প্রিয়জনের অবয়ব। একটি পাটি বুনতে দুই থেকে তিনদিন সময় লাগে।
এ শীতল পাটিকে ঘিরে যুগে যুগে কত গান, কত কাব্য রচিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আসুক আসুক মেয়ের জামাই, কিছু চিন্তা নাইরে, আমার দরজায় বিছাই থুইছি, কামরাঙা পাটি নারে”পল্লীকবি জসিমউদদীন তাঁর নকশীকাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থে কামরাঙা নামক শীতল পাটির বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন।
চাঁদপুর গ্রামের সুকুমার চন্দ্র জানান যে, সারা বাংলাদেশেই তাদের এই শীতল পাটির চাহিদা রয়েছে , তবে মূলধনের অভাবে এ পেশাতে টিকে থাকা কষ্টকর হচ্ছে। তাই সরকার সহজ শর্তে ঋণ দিলে আমাদের কাজে আরো গতি বাড়ত।